ব্যাংক মার্জারের ঝড় ডোবাচ্ছে শেয়ারবাজার

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের শেয়ারবাজারে পতনের ধারাবাহিকতা যেন থামছেই না। বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট চরমে পৌঁছেছে। টানা ১৪ মাস ধরে দেখা যাচ্ছে—এক দিন সূচক বাড়লেও পরের তিন দিনই পতন হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাজার কার্যত সরকারের মনোযোগের বাইরে পড়ে আছে বলে অভিযোগ বাজারসংশ্লিষ্টদের।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে কোনো কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) একের পর এক বড় দরপতনের রেকর্ড গড়ছে। গতকাল সূচক কমেছে ৮১ পয়েন্ট, যা বাজারের ভঙ্গুর অবস্থাকে আরও স্পষ্ট করেছে। এর ফলে টানা পাঁচ কার্যদিবস ধরে দরপতন অব্যাহত থাকল।

বিনিয়োগকারীরা বলছেন, মূল সংকটের উৎপত্তি হয়েছে দুর্বল আর্থিক ভিত্তির পাঁচটি ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত এবং ৯টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের উদ্যোগ থেকে। এতে সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এর ফলে শেয়ার বিক্রির চাপ বেড়েছে এবং বাজার মূলধন আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এই অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে তুলেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত, যেখানে পাঁচটি ব্যাংক—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক—কে একীভূত করে একটি নতুন ব্যাংক গঠন করা হবে, যার নাম হতে পারে “ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক”। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই একীভূতকরণে আগের ব্যাংকগুলোর সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কোনো স্থান থাকবে না। অর্থাৎ বহু বছরের বিনিয়োগ শূন্য হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষ্য অনুযায়ী, নতুন ব্যাংকে নতুন শেয়ার ইস্যু করা হবে এবং পুরনো শেয়ারহোল্ডাররা এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবেন না। এই ঘোষণায় বাজারে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এরই প্রভাবে এক সপ্তাহেই ডিএসই সূচক কমেছে ১৩২ পয়েন্ট এবং বাজার মূলধন কমেছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। শুধু গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের দাম এক বছরে ৫.৪০ টাকা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১.৯০ টাকায়, পতন প্রায় ৬৫ শতাংশ।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছে। এতে চারটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে:

১) ব্যাংকের সব সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন করে শেয়ারহোল্ডারদের অংশ নির্ধারণ;

২) দায়ী উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠন;

৩) সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ন্যূনতম স্বার্থমূল্য নিশ্চিত করা;

৪) চূড়ান্ত মূল্যায়নের আগে ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজার থেকে তালিকাচ্যুত না করা।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেছেন, ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে একীভূতকরণ প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা না করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত পুরো শেয়ারবাজারকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তিনি বলেন, “সরকার যদি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে, তাহলে আস্থা ফিরবে না। আমরা ডিবিএর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়ে আলোচনায় আমাদের অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছি।”

গতকালের বাজার বিশ্লেষণেও দেখা গেছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে দরবৃদ্ধির তুলনায় দরপতনের হার সাত গুণ বেশি ছিল। প্রধান সূচক ডিএসইএক্স এক দিনে কমেছে ১.৫৪ শতাংশ, যা নিয়ে সূচক তিন মাস আগের অবস্থানে ফিরে গেছে। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক সিএসপিআই কমেছে ১৮৫ পয়েন্ট।

বিশ্বব্যাপী সেপ্টেম্বর মাসে অন্যান্য শেয়ারবাজার ভালো পারফর্ম করলেও, বাংলাদেশ ছিল সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান এবং পাকিস্তানের বাজারে যথাক্রমে ১০, ৯ ও ৭.৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে পতন হয়েছে ৩.২০ শতাংশ। এতে স্পষ্ট যে, দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এবং বিনিয়োগ স্থবিরতা বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

সব মিলিয়ে, শেয়ারবাজারে আস্থার যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে হলে প্রয়োজন বিনিয়োগবান্ধব ও স্বচ্ছ নীতিমালা, বিনিয়োগকারীদের জন্য সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং বাজারে নিয়মিত তদারকি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *