ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারমূখী করার উদ্যোগ কেন সফল হচ্ছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক: শেয়ারবাজারের মন্দাভাব কাটাতে দেশের ব্যাংকগুলোকে সম্পৃক্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। কিন্তু তারপরও ব্যাংকগুলোকে কাংখিত পর্যায়ে বাজারমূখী করা যাচ্ছে না। এমনটা অভিযোগ করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরাও। সপ্তাহের বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় তাদের সেই অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া যায়।

গেল সপ্তাহে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারদর ও লেনদেন আগের সপ্তাহের তুলনায় কমেছে। বাজার বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, বাজারকে টেনে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ব্যাংক খাতকে। কিন্তু ব্যাংক খাত কতোটা সেই দায়িত্ব পালন করার জন্য এগিয়েছে-তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়াতে প্রথম দফায় ব্যাংকগুলোর অর্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে। তারপর গত বুধবার ৬১টি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের বরাবরে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠিয়েছে।ব্যাংকগুলো যাতে শেয়ারবাজারে সক্রিয় করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানামুখী চেষ্টা চলছে। বাজার সংশ্লিষ্টদের একটি অংশ বলছেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য গঠিত ব্যাংকগুলোর বিশেষ তহবিলের পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। এছাড়া, শেয়ারবাজারের জন্য গঠিত বিশেষ তহবিলের বাইরে আরও প্রায় ৯০০ কোটি টাকা নিজস্ব তহবিল থেকে বিনিয়োগ করেছে ব্যাংকগুলো। বেশ কয়েকটি ব্যাংক সীমা অতিক্রম করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে গিয়ে জরিমানাও গুনেছে। তবু শেয়ারবাজারে চাঙাভাব ফিরেনি।

চিঠি দেওয়ার পরের দিন বৃহস্পতিবার দেশের শেয়ারবাজারে নতুন কোন গতিই দেখা যায়নি। বরং উভয় বাজার মন্দাভাবের দিকেই ঝুঁকে ছিল। এদিন লেনদেনের গতিও কমে গেছে। তবে ব্যাংকখাত সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে ধীরে ধীরে বিনিয়োগ করবে। যে কারণে ব্যাংকের বিনিয়োগ হঠাৎ করে দৃশ্যমান হবে না। দৃশ্যমান হতে সময় লাগবে।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ব্যাংকগুলো যাতে নিয়মের মধ্যে থেকে শেয়ারবাজারে সক্রিয় হয়, সে জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সায় রয়েছে। তারা শেয়ারবাজার নিয়ে আগে যতো নেতিবাচক অবস্থানে ছিল, এখন ততোটা নেই।

নাম প্রকাশ না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা শেয়ারনিউজকে বলেন, শেয়ারবাজারে ব্যাংক যাতে বাড়তি টাকা বিনিয়োগ করতে পারে এবং এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাতে সায় দেয়, সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে বলা আছে।গত বুধবার দেশের ৩৩টি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের শেয়ারবাজারে গঠিত বিশেষ তহবিল থেকে বিনিয়োগ বাড়াতে চিঠি দেয় বিএসইসি। এর বাইরে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য ২০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের অনুরোধ জানিয়ে আরও ২৮টি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে চিঠি পাঠায়।

বিএসইসির পক্ষে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম এই আহ্বান জানান।

বিএসইসি বলছে, আমাদের দেশের শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে এখনও প্রধান ভূমিকা পালন করে ব্যাংক। ব্যাংকের বিনিয়োগ ছাড়া শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানোর তেমন কোনও বিকল্পও নেই। তাই বাজারে লেনদেন ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, এক সপ্তাহ কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী থাকার পর গত সপ্তাহে আবার দরপতন হয়েছে দেশের শেয়ারবাজারে। এতে গত সপ্তাহে ডিএসইর বাজার মূলধন আড়াই হাজার কোটি টাকার ওপরে কমে গেছে। এর আগে টানা চার সপ্তাহের পতনে ৩১ হাজার কোটি টাকা মূলধন হারানোর পর গেলো সপ্তাহের আগের সপ্তাহে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো বাজার মূলধন বেড়েছে। বাজার মূলধনের পাশাপাশি গেলো সপ্তাহে কমেছে প্রধান মূল্যসূচক ও লেনদেনের পরিমাণ।

সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসের লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩৮ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। যা তার আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ছিল ৫ লাখ ৪০ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। অর্থাৎ গেলো সপ্তাহে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ২ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা।অবশ্য আগের সপ্তাহে বাজার মূলধন বেড়েছিল ৫ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা। তার আগের চার সপ্তাহের টানা পতনে বাজার মূলধন কমে যায় ৩১ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা।

তথ্য বলছে, বাজার মূলধন কমার পাশাপাশি গেলো সপ্তাহে ডিএসইতে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম কমার তালিকায় নাম লিখিয়েছে। সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেওয়া ১০৫টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২৬৪টির। আর ১৬টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।

এতে গত সপ্তাহে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স কমেছে ১২ দশমিক ৭২ পয়েন্ট। আগের সপ্তাহে সূচকটি বাড়ে ৯৭ দশমিক ৪৪ পয়েন্ট। তার আগের চার সপ্তাহের টানা পতনে সূচকটি কমেছিল ৪১৭ দশমিক ৮০ পয়েন্ট।গত সপ্তাহের প্রতি কার্যদিবসে ডিএসইতে গড়ে লেনদেন হয়েছে ৭৮০ কোটি ২৩ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছিল ৯৭১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কার্যদিবসে গত সপ্তাহে গড় লেনদেন কমেছে ১৯১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। গত সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ৩ হাজার ৯০১ কোটি ১৯ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয় ৩ হাজার ৮৮৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। সে হিসাবে মোট লেনদেন বেড়েছে ১৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা।

ব্যাংকখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকগুলো যদি শেয়ারবাজারে সত্যিকার অর্থে বিনিয়োগ করতে চায়, তাহলে নিয়মের মধ্যে থেকে তাদের আর প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে করতে আগ্রহী কীনা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের স্পষ্ঠ নির্দেশনা না পেলে ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করবে কীনা, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারমূখী করতে হলে বিএসইসিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রীন সিগনাল নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রীন সিগনাল না মিললেও বিএসইসির পক্ষে যতোই উদ্যোগ নেওয়া হোক না কেন, ব্যাংকগুলো কাংখিতভাবে বাজারমূখী হবে না। এক্ষেত্রে বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের আলোচনা সর্বাঙ্গে প্রয়োজন। তাহলেই ব্যাংকের বাজারমূখী হওয়ার পথে জমানো সব বরফ গলতে শুরু করবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *