বিরল দৃষ্টান্ত আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের!

নিজস্ব প্রতিবেদক : শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ব্যাংকটির মোট ৩৩টি শাখার মধ্যে ১৮টিই লোকসানে পরিচালিত হচ্ছে। ব্যাংকটির আয় অপেক্ষা ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি, যা ব্যাংকিং খাতে বিরল।

ব্যাংকির খাতে একমাত্র লোকসানি কোম্পানি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের বিনিয়োগের (ঋণের) সাড়ে ৭৮ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। খেলাপিঋণের প্রায় শতভাগই মন্দমানের, যা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিপুল অঙ্কের খেলাপিঋণের কারণে প্রতি বছরই নিট লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে।

তীব্র মূলধন ও তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকটির পূঞ্জীভূত লোকসান বাড়তে বাড়তে এখন ১৯০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ফলে সময়মতো গ্রাহকের আমানতের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না।

ব্যাংকটির কাছে এখনো আমানতকারীদের পাওনা রয়েছে প্রায় ৪২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) প্রায় ৭ কোটি টাকার আমানত আটকে আছে। সম্প্রতি ওই টাকা ফেরত পেতে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করে চিঠি দিয়েছে রাকাব।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকটির অবস্থা এতই নাজুক যে, নতুন মূলধন জোগান ছাড়া ব্যাংকটির কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তবে ব্যাংকটি সাবেক মালিকদের শেয়ার বাজেয়াপ্তকরণ নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে মামলা চলমান থাকায় বর্তমান মালিকরা নতুন করে মূলধন সরবরাহে আগ্রহী নয়। ফলে পুনর্গঠনের প্রায় ১৫ বছরেও ঝিমিয়ে চলছে ব্যাংকটি।

জানা গেছে, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ১৯৮৭ সালের ২০ মে আল-বারাকা ব্যাংক বাংলাদেশ নামে কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৪ সালে মালিকানা পরিবর্তন হওয়ার পর ওরিয়েন্টাল ব্যাংক নামে কার্যক্রম চালায় ব্যাংকটি।

মালিকানা হস্তান্তরের পর ২০০৬ সালে সীমাহীন ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে ব্যাংকটিতে। ফলে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়। শৃঙ্খলা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বসানো হয় প্রশাসক। কিন্তু তারল্য সংকটের কারণে ওই সময় ব্যাংকটি থেকে টাকা তুলতে পারছিলেন না আমানতকারীরা।

এরপর সরকার আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ২০০৭ সালে একটি স্কিম চালু করে। পরবর্তী সময়ে ব্যাংকটির বেশিরভাগ শেয়ার বিক্রির জন্য নিলাম ডাকা হলে তা কিনে নেয় সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ এজি।

২০০৮ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের সব সম্পত্তি ও দায় নিয়ে নতুন নামে যাত্রা শুরু করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। কিন্তু তার পরও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ব্যাংকটি। টানা লোকসান ও খেলাপিতে জর্জরিত ব্যাংকটি গ্রাহকের আমানতের অর্থও ফেরত দিতে পারছে না।

আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের কাছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের এখনো ৬ কোটি ৮৫ লাখ ২৬ হাজার ৫৫৯ টাকার আমানত আটকে আছে। এই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পাঠানো রাকাবের চিঠিতে বলা হয়, সরকার গঠিত স্কিমের আওতায় সর্বশেষ ২০১৬ সালের নভেম্বরে ১৭তম কিস্তি পর্যন্ত পরিশোধ করেছে আইসিবি। পরবর্তী কিস্তিগুলো পরিশোধে বারবার অনুরোধ করা হলেও ব্যাংকটি পরিশোধ করছে না। বকেয়া কিস্তিগুলো পরিশোধ না করায় রাকাবের নিরীক্ষা কাজে নিয়োজিত বহিঃহিসাব নিরীক্ষা দল এই টাকা আদায় অনিশ্চিত বলে আপত্তি উত্থাপন করে। তাই এসব কিস্তির টাকা পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে চিঠিতে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী এই বিষয়ে বলেন, আমানতকারীদের পাওনা পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একটি স্কিম গঠন করে দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যাশা ছিল, ব্যাংকটি বিদ্যমান খেলাপি বিনিয়োগগুলো ফেরত আনতে পারবে এবং সেটা নতুনভাবে বিনিয়োগ করে যে আয় আসবে, সেই আয় থেকে আমানতকারীদের অর্থ ধাপে ধাপে পরিশোধ করতে পারবে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও আমানতকারীদের টাকা পরিশোধ করতে পারেনি ব্যাংকটি। এর মানে খেলাপি বিনিয়োগের বড় অংশই আদায়ে সক্ষম হয়নি তারা। লোকসানি শাখাও কমিয়ে আনতে পারেনি। আবার নতুন মূলধনের জোগান দিয়ে বিনিয়োগ বাড়িয়ে আয় বাড়ানোর তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, বাজার অর্থনীতিতে টিকে থাককে হলে, ভালোভাবে ব্যবসা করেই টিকে থাকতে হবে। না পারলে কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হবে। কিন্তু বসে বসে লোকসানের ঘানি টানার কোনো মানে হয় না। এটা ব্যাংক খাতে ভালো বার্তা দেয় না।

ব্যাংকটির ২০২১ সালের কুইক রিভিউ প্রতিবেদন (কিউআরআর) পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রায় সব সূচকেই হতাশা বিরাজ করছে। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ৬৬৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা হলেও গত বছর শেষে পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯২৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এই লোকসান সমন্বয়ের পর সংরক্ষিত মূলধন দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ১ হাজার ২৬১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। একই সময়ে ব্যাংকটির ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে হয়েছে ৯১৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ফলে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের সঙ্গে মূলধনের হার নির্ণীত হয়েছে ঋণাত্মক ১৩৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণের ধারে কাছেও নেই ব্যাংকটি।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বিপুল অঙ্কের খেলাপির কারণে ব্যাংকটি প্রতি বছর নিট ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ২০২১ সালে নিট লোকসানের পরিমাণ ৪০ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালে ছিল ২১ কোটি টাকা। তার আগের বছর নিট লোকসানের পরিমাণ ছিল আরও বেশি, ৪২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকটি যেহেতু ‘দি ওরিয়েন্টাল ব্যাংক পুনর্গঠন স্কিম ২০০৭-এর আওতায় আমানতকারীদের অর্থ ফেরতে সক্ষম হচ্ছে না, সেহেতু নিশ্চিতভাবেই ব্যাংকটি তারল্য সংকটে রয়েছে। জানা যায়, সরকার গঠিত স্কিমের আওতায় ২০২১ সালের ৪ নভেম্বরের মধ্যে ফ্রোজেন ডিপোজিটের ৪৭৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা গ্রাহকদের ফেরত প্রদানের শর্ত দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু ওই সময় শেষ হলেও ৪২৫ কোটি টাকার মতো অপরিশোধিত রয়েছে। এখন এই অর্থ পরিশোধে ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সময় চেয়ে আবেদন করেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *