নিজস্ব প্রতিনিধি
বাংলাদেশ সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের শেয়ারবাজার চাঙ্গা করার জন্য অনেক প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। যার সুফল বাজারে ইতোমধ্যে পড়ছে।
আমাদের দেশে ব্যক্তি মালিকানা বোধ থেকে কর্পোরেট মালিকানা বোধের যে সাংস্কৃতিক বিবর্তন হওয়ার কথা তা পশ্চিমা দেশের মত করে বিকশিত হয়নি। আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক এবং ছাত্র সমাজ কর্পোরেট মালিকানা বোধকে খুব একটা স্বাগতঃ জানায়নি বা আপন করে নিতে পারেনি। শিক্ষক সমাজ,ছাত্র সমাজ কিংবা জনগণ কেউ কর্পোরেট সংস্কৃতি চায় না।কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং জনগ্ণের মধ্যে কর্পোরেট মালিকানা সম্পর্কে নেতিবাচক আলোচনা বেশি হয়। মালিক সমাজও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাশের দিকে খুব একটা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক এবং ছাত্র সমাজও তাদের খুব একটা ডাকে না। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যিক অনুষদের ছাত্র শিক্ষকদেরকে শেয়ারমার্কেটের সাথে নানাভাবে সম্পৃক্ত করা দরকার।এটা চেয়ারম্যান মহোদয় বিদেশে যেভাবে রোড শো করে বুঝাচ্ছেন দেশেও সেভাবে রোড শো করে জনগণকে বুঝাতে হবে । এখানে প্রাইভেট কোম্পানি মালিকদের কোন সমাবেশ বা জবফেয়ার হয়না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস বা কারিকুলাম বাজার , কর্মসংস্থান বা জীবন মুখী নয়। এগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী হালনাগাদ করা হয়না। ফলে এগুলো এখন বেকার উৎপাদন কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে এবং অভিভাবকদের শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি করছে মাত্র।ছাত্র সমাজ মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে ওঠছে না। ফলে ছাত্র সমাজ নিয়োগের ক্ষেত্রে এর সুফল লাভ করেনি। মালিক সমাজও সাম্রাজ্য হারানোর ভয়ে কর্পোরেট মালিকানাকে প্রথম থেকে সন্দেহের চোখে দ্যাখে। মালিক সমাজ মালিকানা এবং ব্যবস্থাপনা নিজের হাতে ধরে রাখতে চায়। হাতছাড়া করতে চায় না। পেশাদার ব্যবস্থাপকদের প্রতি তাদের আস্থা কম। এখানে অর্থ এবং জ্ঞানের কোনো কার্যকর সমন্বয় ঘটছে না। ফলে জ্ঞানের কোনো অর্থনৈতিক এবং বাণ্যিজ্যিক ভ্যালু তৈরী হচ্ছে না। যে কারণে উন্নত দেশের মত নলেজ ইকোনমির বিকাশ বাংলাদেশে ঘটছে না।ধনতন্ত্র ঠেকানো সম্ভব নয় বলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই যেভাবেই হোক মালিকদের আস্থা অর্জন করতে হবে।
শেয়ার মার্কেটে ট্রেড করতে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর তীব্র অনীহা। এই অনীহা দূর করতে হলে আরো আকর্ষণীয় প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার প্রয়োজন আছে।প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর কাছে প্রাইমারি মার্কেটকে আরো লোভনীয় করে সাজাতে হবে। ব্রোকার হাউজগুলোর মাধ্যমে কোম্পানিগুলোকে বাজারে পুঁজি সংগ্রহের জন্য প্রলুব্ধ করতে হবে। বাজার থেকে পুঁজি তোলাকে আরো সহজ করতে হবে। শেয়ারবাজারকে উন্নত দেশের আদলে সংস্কার করা উচিৎ। কোম্পানি আইনকে আরো সহজ এবং বিনিয়োগবান্ধব করা দরকার।পুঁজিবাজার সাংবাদিকতাকে আরও বিকশিত এবং পেশাদার করা উচিৎ।বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যিক অনুষদ্গুলোর সাথে ক্যাপিটাল মার্কেট জার্ণালিষ্ট ফোরামের ঘনঘন মতবিনিময় হওয়া উচিৎ। একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক জার্নালিষ্ট ফোরাম এবং জাতীয় রাজস্ববোর্ড সাংবাদিক ফোরাম গঠন করা দরকার। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ক্যাপিটাল মার্কেটে সাংবাদিকদের ঘন ঘন প্রশিক্ষণ হওয়া দরকার।বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাংবাদিকদের মিথস্ক্রিয়া এক রকম হয় না বললেই চলে। এই সব কারণে পাশ্চাত্যের মত কর্পোরেট বা বুর্জোয়া সংস্কৃতি আমাদের দেশে বিকশিত হয়নি। এজন্য আমাদের দেশে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই পারিবারিক কোম্পানির মত। দেশে প্রাইভেট কোম্পানি লক্ষ লক্ষ । অথচ পাবলিক কোম্পানি মাত্র সাড়ে তিন হাজারের কিছুটা বেশি। আর শেয়ার মার্কেটে আছে মাত্র সাড়ে সাত শত পাবলিক কোম্পানি। এত কম কোম্পানি নিয়ে কিভাবে একটি সরগরম এবং চাঙ্গা শেয়ারবাজার গঠন করা সম্ভব? শেয়ারবাজারের গভীরতা বাড়াতে হবে। প্রায় ত্রিশ হাজার কোটি টাকার হাউজিং সেক্টর, বিশ হাজার কোটি টাকার ক্লিনিক ব্যবসা, পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকার পরিবহণ ব্যবসা, লক্ষ কোটি টাকার ঠিকাদারি ব্যবসা ইত্যাদি চলছে ব্যক্তিগত মালিকানায়। কোনো করছাড় নেই। তাই কেউ কোম্পানি করতে চায় না। বরং কোম্পানি করলে তাকে আরো করারোপ করা হয়। অথোরাইজড ক্যাপিটাল কত হলে কোম্পানি করা বাধ্যতামূলক তার কোনো উল্লেখ কোম্পানি আইনে নেই।পাঁচ কোটি হোক বা দশ কোটি হোক আইনে একটা শিলিং থাকতে হবে। সেইসাথে কর্পোরেট ট্যাক্স হার আরো কমাতে হবে। শেয়ার মার্কেটে ঢুকে লাভ না দেখলে কেউ এখানে আসবে না।মার্কেট হবে একই সাথে কোম্পানি এবং বিনিয়োগকারী বান্ধব। বাজারকে পাম্প এবং ডাম্প করার কারসাজি বন্ধ করতে হবে। এটা কমানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং ছাত্র সমাজ দিয়ে এডভোকেসি প্রোগ্রাম জোরদার করতে হবে। এটা করা গেলে দেশে হাজার হাজার কোম্পানি তৈরী হবে। শেয়ার মার্কেটে ঢুকলে আরো কর ছাড় দিতে হবে। শিক্ষিত বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য এগুলো করা লাগবে। এছাড়া এই মুহূর্তে এর কোনো ভাল বিকল্প নেই। ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে এর ভাবমূর্তি সঙ্কট দূর করতে হবে। প্রয়োজনে কমিশন প্রাইভেট চ্যানেলের চাংক ভাড়া নিয়ে বাজারের কোম্পানিগুলোর তথ্য উন্মুক্ত করতে পারে যাতে ইন্সাইড ট্রেডিং বন্ধ হয়। বাজার বোদ্ধাদের বক্তব্য এখানে প্রচার করা যেতে পারে। গ্রাজুয়েট পপুলেশনকে এখানে ট্রেড করার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ব্রোকার হাউজের সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে এবং এগুলোকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। অনলাইন ট্রেডিং আরো সহজ করতে হবে। কর্পোরেট হাউজের সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। শিক্ষিত বেকার সমস্যা সমাধানে কর্পোরেট আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে হবে। ব্যবসা বাণিজ্য আরো সহজ করে করের বোঝা কমাতে হবে।
যে কোনো মূল্যে মার্জিন লোনের সুদ কমাতে হবে।বাজারের দীর্ঘ মেয়াদী দূরবস্থায় উচ্চসুদের মার্জিন লোনের অক্টোপাশে যারা আটকা পড়েছে তাদের সুদের হার কমিয়ে উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে হবে। যে কোনো মূল্যে ব্রোকার হাউজের কোষ্ট অব ফাণ্ড আরো কমাতে হবে।মার্জিন লোনের সুদের হার কোনোক্রমেই ১০% এর উপরে থাকা উচিৎ নয়। কর্পোরেট সুশাসন এখানে অপরিহার্য। আর্থিক প্রতিবেদনে শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। শেয়ারবাজার অর্থনীতির ব্যারোমিটার। এটা ফটকা বাজার নয় – হালাল ব্যবসা।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অনেকদিন ধরে এদেশ থেকে একতরফাভাবে মুনাফা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের শেয়ারবাজারে ট্রেড করার জন্য তাদের আমরা বাধ্য করতে পারছি না। এই কারণে আমরা বহু দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এদেশে তারা স্বচ্ছভাবে ব্যবসাবাণিজ্য করছে কিনা দেশের জনগণ আর্থিক প্রতিবেদন অপ্রকাশিত থাকার দরুন জানতে পারছে না। তারা ঠিকমত ভ্যাট ট্যাক্স দিচ্ছে কিনা এটাও জনগণ জানতে পারছে না। তাদের মুনাফায় এদেশের জনগণ ভাগ বসাতে পারছে না যেটা ভারতের জনগণ পা্চ্ছে। বিনিয়োগকারীগণ বিশ্বমানের ভাল কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলো দেশের বাজারে প্রবেশ করছে না। ফলে তাদের মুনাফায় জনগণ ভাগ বসাতে পারছে না এবং তাদের আর্থিক স্বচ্ছতা সম্পর্কে জনগণ অন্ধকারে থাকছে।