ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ গ্যারান্টারদের মহাবিপদ

নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যাংক বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ ঋণ নিতে চাইলে তার গ্যারান্টর হওয়ার আগে এখন থেকে ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ গ্যারান্টররা আর মূল ঋণগ্রহীতাদের থেকে সম্পর্ক চিন্ন করে গা বাঁচাতে পারবে না। মূল ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে আদালতের স্থগিতাদেশকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সুদসহ পুরো ঋণ শোধের দায়ও এড়াতে পারবে না তারা।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে একটি আপিল নিষ্পত্তি করে আদালত রায় দেন, গ্যারান্টররা রিট দায়ের করে নিলাম কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে না। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, অর্থ ঋণ আদালত আইন-২০০৩ অনুযায়ী কোনো গ্যারান্টরের সম্পত্তি নিলামে তুলে ব্যাংকের পাওনা সমন্বয় করতে কোনো বাধা নেই।

কোনো ঋণগ্রহীতা ঋণ শোধে ব্যর্থ হলে তার গ্যারান্টরের সম্পত্তি নিলামে তোলার পথ পরিষ্কার হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ওই ঐতিহাসিক রায়ে।

সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ বছরে গ্যারান্টররা ১৩ হাজার ৬৪১টি রিট দায়ের করেছে তাদের সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করে ব্যাংকের পাওনা সমন্বয় করার বিরুদ্ধে। এসব রিটের মধ্যে ৮০ শতাংশ আদেশ গেছে রিটকারীদের পক্ষে। দায়ের হওয়া রিটগুলোর সঙ্গে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণ জড়িত।

আর্থিকখাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এই রায়ের ফলে তাদের খেলাপি ঋণ আদায়ের কার্যক্রম গতি পাবে। তারা বলছেন, ঋণ ওঠানোর নিশ্চয়তা পাওয়ার জন্য আইন অনুযায়ী ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার সময় গ্যারান্টর নিয়োগ করে। ‘আপিল বিভাগের ওই ঐতিহাসিক রায় সেই পথকে সুগম করল।

তারা বলছেন, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই সহজে গ্যারান্টর হয়ে যায়। কিন্তু এখন থেকে গ্যারান্টর হওয়ার আগে তারা ঋণ শোধের সামর্থ্য নিয়ে দুবার ভাববে। এতে ব্যাংকগুলোর জন্য ঋণ আদায় সহজ হবে।

গ্যারান্টররা কেন বিপাকে

ব্যাংক কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ইমরান আহমেদ ভূঁইয়া সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণের বিপরীতে জামানত হিসাবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই জামিনদার বা গ্যারান্টর হিসাবে এক বা একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান গ্যারান্টি দিয়ে থাকে।

ঋণ খেলাপি হলে গ্যারান্টরের ওপরও দায় বর্তায় ঋণ পরিশোধের জন্য। আর সেজন্যই ঋণ না নেওয়া সত্ত্বেও গ্যারান্টররাও ঋণখেলাপি হয় বলে জানান ইমরান।

‘আর তাই ঋণ খেলাপি হলে ঋণ আদায়ের জন্য কেবল ঋণগ্রহীতা নয়, গ্যারান্টরের বিরুদ্ধেও মামলা করার বিধান রয়েছে বিদ্যমান অর্থ ঋণ আদালত আইনে,’ বলেন তিনি।

গ্যারান্টরদের যতগুলো রিট পিটিশন পেন্ডিং আছে

২০২২ সালে গ্যারান্টররা ৩ হাজার ১৪৪টি রিট পিতিসন দায়ের করে, যার মূল মামলার সঙ্গে জড়িত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২১ সালে এমন পিটিশনের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৮৬২টি, যার মূল মামলার সঙ্গে জড়িত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। আর ২০২০ সালে পিটিশন ছিল ২ হাজার ১১৩টি, যার মূল মামলার সঙ্গে জড়িত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

২০১৯ সালে গ্যারান্টররা ২ হাজার ৯৭৬টি রিট পিটিশন করে, যার মূল মামলার সঙ্গে জড়িত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ছিল ২ হাজার ৫৪৬, যার মূল মামলার সঙ্গে জড়িত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা।

কী হবে এসব রিটের

ব্যাংক কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ শাহ মোহাম্মদ আহসানুর রহমান বলেন, আপিল বিভাগের ঐতিহাসিক রায়টির ফলে সামাজিকভাবে ঋণ খেলাপিরা ‘একরকম শাস্তির আওতায় আসবে’।

‘কারণ এখন থেকে সহজে কেউ গ্যারান্টর হতে রাজি হবে না। আর যখন গ্যারান্টর পাওয়া যাবে না, তখন ঋণ নেওয়ার সময় ঋণ গ্রহীতারা বেশ সতর্ক হবে,’ বলেন তিনি।

আহসানুর রহমান বলেন, ‘ঋণ খেলাপিরা নানা কৌশলে হাইকোর্টে এসে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) তালিকা থেকে নাম কাটার জন্য রিট করত। এখন সেটি প্রায় বন্ধ।’

এই আইন বিশেষজ্ঞ বলেন, নিলাম ঠেকাতে গ্যারান্টরদের যেসব রিট এখনও হাইকোর্টে পেন্ডিং আছে, আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী সেগুলো খারিজ হবে।

তবে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, আপিল বিভাগের রায়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, গ্যারান্টরদের নতুন যেকোনো রিট হাইকোর্ট যাতে সাবধানতার সঙ্গে শুনানি করেন এবং আদেশ দেন। আর পুরনো রিটগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চগুলোকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *