নিজস্ব প্রতিবেদক
দীর্ঘদিনের মন্দায় শেয়ারবাজার তার জৌলুশ হারিয়েছে। প্রায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে সূচক ও লেনদেন ক্রমেই নিম্নমুখী। ব্রোকারেজ হাউজের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে লেনদেন করে থাকেন।লেনদেনের ওপর কমিশন থেকেই মূলত আয় করে থাকে এসব প্রতিষ্ঠান। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে পুঁজিবাজারে লেনদেনের মন্দার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের আয় ধস নেমেছে।
জানা যায়, বর্তমানে ৯০ শতাংশ ব্রোকারেজ হাউজকেই পরিচালন লোকসান গুনতে হচ্ছে। এ অবস্থায় বড় ও ভালো কোম্পানির শেয়ার তালিকাভুক্তির মাধ্যমে বাজারের লেনদেন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া না হলে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বর্তমানে ট্রেকহোল্ডারের সংখ্যা ৩০৯।এর মধ্যে গত দুই বছরে ৫৯টি প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে ট্রেক ইস্যু করা হয়েছে।এক্সচেঞ্জটির ব্রোকারেজ হাউজগুলোর অধিকাংশই ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবসিডিয়ারি হিসেবে বেশকিছু করপোরেট ব্রোকারেজ হাউজ রয়েছে। এর বাইরে কিছু করপোরেট গ্রুপের মালিকানাধীন ব্রোকারেজ হাউজও রয়েছে। মূলত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও করপোরেট গ্রুপের মালিকানাধীন ব্রোকারেজ হাউজগুলোর মাধ্যমেই পুঁজিবাজারের সিংহভাগ লেনদেন হয়ে থাকে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) তথ্যানুসারে, পুঁজিবাজারে এক বছর ধরে গড়ে ৬০০ কোটির লেনদেন হচ্ছে। এ লেনদেনের ৭০ শতাংশই হয় শীর্ষ ৩০ ব্রোকারের মাধ্যমে। বাকি ৩০ শতাংশ লেনদেন করে ৭০ শতাংশ ব্রোকার। এক্ষেত্রে ১৮০ কোটি টাকার লেনদেন করে ২২০টি ব্রোকার। এতে প্রতিটি ব্রোকারের গড়ে ১ কোটি টাকাও লেনদেন হয় না। এত কম লেনদেন দিয়ে পরিচালন ব্যয় মেটানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে প্রতি মাসে গড়ে দেড় কোটি টাকা পরিচালন ব্যয় হয়ে থাকে। যদিও লেনদেনের কমিশন আয় থেকে এ খরচ মেটানো সম্ভব নয়। যেসব ব্রোকারের কোনো ভাড়া গুনতে হয় না, নিজস্ব জায়গায় প্রতিষ্ঠান তারা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। এ ধরনের কিছু ব্যতিক্রমী উদাহরণ ছাড়া বর্তমানে ৯০ শতাংশ ব্রোকারেজ লোকসান গুনতে হচ্ছে।
ডিবিএর প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই পুঁজিবাজারের লেনদেনে মন্দা দেখা যাচ্ছ।এতে ৯০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানকেই লোকসান গুনতে হচ্ছে। ২ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হলে বড়-ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ব্যবসার ভাগাভাগিটা তুলনামূলক যৌক্তিক হয়ে থাকে।লেনদেন না বাড়লে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। আর লেনদেন বাড়াতে হলে পুঁজিবাজারে ভালো শেয়ারের জোগান বাড়াতে হবে।গত ১০-১২ বছর ধরে বাজে কোম্পানির শেয়ার এসেছে।প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের মাধ্যমে পুঁজিবাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। এ বাজারকে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল করতে হলে বড় কোম্পানির শেয়ার তালিকাভুক্ত করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে আকর্ষণীয় প্রণোদনা না থাকার কারণে বড় কোম্পানিগুলো আসতে আগ্রহী হচ্ছে না। বাজারকে গতিশীল করতে হলে স্টক এক্সচেঞ্জের কার্যপরিধি আরো বাড়ানোর পাশাপাশি আরো ক্ষমতা প্রদান করতে হবে বলে জানান তিনি।
ব্রোকারেজ হাউজের কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের বেতন পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে। সময়ের পরিক্রমায় সবকিছু বাড়লেও পুঁজিবাজারে লেনদেন কমছে। বর্তমানে সুদের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর বাড়তি ব্যয় হচ্ছে। সম্প্রতি একটি ব্রোকারেজ হাউজের মালিক তার নিজের অন্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে অর্থ এনে কর্মীদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য ব্যয় মিটিয়েছেন। অনেক ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সে সক্ষমতাও নেই। পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে শিগগিরই পরিত্রাণ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে অনেক ব্রোকারেজ হাউজের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
পুঁজিবাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২২ সাল শেষে আগের বছরের তুলনায় ডিএসইএক্স সূচক ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৬ হাজার ২০৭ পয়েন্টে।এর পরের বছর সূচকটি মাত্র দশমিক ৬৪ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার ২৪৭ পয়েন্টে দাঁড়ায়। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৬ হাজার ২৪৩ পয়েন্টে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সূচকটি ৫ হাজার ৩৫৫ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
২০২২ সালে ডিএসইতে দৈনিক গড়ে লেনদেন হয়েছিল ৯৬০ কোটি টাকা, যা এর আগের বছরের তুলনায় ৪৫ শতাংশ কম। ২০২৩ সালে এক্সচেঞ্জটিতে দৈনিক গড় লেনদেন ৪০ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৫৭৮ কোটি টাকায়।চলতি বছরের শুরুর দিকে লেনদেন ও সূচকে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখিতা দেখা গেলেও গত মার্চ থেকেই কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া লেনদেনের পরিমাণ ক্রমেই কমছে।
ইবিএল সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ছায়েদুর রহমান বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে দুই বছরের বেশি সময় ধরে পুঁজিবাজারে মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। এর মধ্যে দেড় বছর তো ফ্লোর প্রাইসের কারণে বাজারে লেনদেন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। একদিকে লেনদেন কমে যাওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। অন্যদিকে লোকসান হলেও ব্রোকারেজ হাউজগুলোকে কর দিতে হচ্ছে। এতে করে প্রতিষ্ঠানগুলোর আরো বেশি আর্থিক চাপের মধ্যে পড়ছে। এ অবস্থায় বিদ্যমান করা কাঠামো পরিবর্তন করে যেসব প্রতিষ্ঠান মুনাফা করতে পারবে তাদের ওপর করারোপ করাটা যুক্তিসংগত। অন্যদিকে যাদের লোকসান হচ্ছে তাদেরকে করভার থেকে পরিত্রাণ দেয়া উচিত।