ন্যূনতম কর ব্যবস্থা দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে

নিজস্ব প্রতিবেদক: আয়কর আইনের অধীনে কোম্পানিগুলোর বার্ষিক টার্নওভারের একটি অংশ ধরে ন্যূনতম কর নির্ধারিত থাকায় যারা প্রকৃত অর্থে মুনাফা করেন না, তারাও কর দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

আয়কর আইনের অধীনে কোম্পানিগুলোর বার্ষিক টার্নওভারের একটি অংশ ধরে ন্যূনতম কর নির্ধারিত থাকায় যারা প্রকৃত অর্থে মুনাফা করেন না, তারাও কর দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ করনীতির ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের অভিযোগ, ব্যবসার টার্নওভারের ওপর ন্যূনতম কর (মিনিমাম ট্যাক্স) হিসেবে কর্তিত আগাম করের চেয়ে কম মুনাফা কিংবা লোকসান হলে পরবর্তী বছরগুলোর সঙ্গে তা সমন্বয়ের সুযোগ রাখা হয়নি। মুনাফা না হলেও কর দেয়ার এ পদ্ধতিকে শাস্তি মনে করেন দেশের উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, এ পদ্ধতি দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে। পাশাপাশি এ কর ব্যবস্থা বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, ব্যবসার ধরনের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে কোম্পানিগুলোকে তাদের বার্ষিক টার্নওভারের ওপর কর দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে টার্নওভার যা-ই হোক, দশমিক ৬ শতাংশ হারে কর দেয়া বাধ্যতামূলক। যেটা বছর শেষে ব্যবসার হিসাব চূড়ান্ত হওয়ার পরও এনবিআরের পক্ষ থেকে ফেরত কিংবা সমন্বয় কোনোটাই করা হয় না। এছাড়া রফতানির ওপর ১ শতাংশ হারে উৎসে কর দিতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এ ক্ষেত্রে কোনো কোম্পানির কাছ থেকে ১ কোটি টাকা নেয়ার পর চূড়ান্ত রিটার্ন দাখিলের সময় যদি দেখা যায়, প্রকৃত কর হয়েছে ২০ লাখ টাকা, তখন বাড়তি ৮০ লাখ টাকা ফেরত দিচ্ছে না এনবিআর।

বিএসআরএম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমের আলীহুসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অগ্রিম কর্তিত কর ফাইনাল সেটলমেন্ট হলেও তা সমন্বয়ের সুযোগ না থাকলে কোম্পানির ব্যালান্স শিট নেগেটিভ হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে গেলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও দুর্বল হয়ে পড়ে। যেসব দেশে ন্যূনতম কর ব্যবস্থা রয়েছে সেটা কিন্তু সমন্বয়যোগ্য। অর্থাৎ পরে কর ফেরত পাবে বা পরবর্তী বছর সেটি অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারবে। তবে বাংলাদেশে এ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।

তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগ ও জিডিপি বাড়াতে এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে কর পদ্ধতিকে উপযুক্তভাবে সাজাতে হবে। এখন সময় এসেছে ন্যূনতম কর ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনার, যাতে প্রকৃত মুনাফার ভিত্তিতে কর নির্ধারণ করা হয়।’

বিশ্বজুড়ে চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব পড়েছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে। সেই সঙ্গে বেড়েছে উৎপাদন ব্যয়ও। মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তা পর্যায়ে ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এ অবস্থায় ন্যূনতম কর আদায় উদ্যোক্তার বিনিয়োগ সক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয় বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।

টিকে গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মাদ মুস্তাফা হায়দার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বৈশ্বিক ও স্থানীয় নানা কারণে কয়েক বছর ধরে ভালো প্রতিষ্ঠাগুলোও হয় লোকসানে ব্যবসা চালাচ্ছে অথবা মুনাফা কমে গেছে। এর ওপর আয়কর আইনের আওতায় বর্তমানে কোম্পানিগুলোকে ব্যবসার ধরন অনুযায়ী বার্ষিক টার্নওভারের শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ ন্যূনতম কর দিতে হয়। রফতানিমুখী শিল্পের রফতানি মূল্যের ওপরও ১ শতাংশ উৎস কর রয়েছে। এসব কর আবার সমন্বয়যোগ্য নয়। অর্থাৎ ব্যবসায় প্রকৃত মুনাফা কম বা লোকসান হলেও কর পরিশোধে ছাড় নেই।’

তিনি বলেন, ‘ব্যবসা পরিচালনা ও উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক গতিও মন্থর। এ কারণে ব্যবসায়ীরা কঠিন সময় পার করছেন। লোকসানে থেকেও অনেকে কর দিচ্ছেন। আবার মুনাফা হলেও কার্যকর কর হয়ে যাচ্ছে তার চেয়েও বেশি।’ এমন নীতি ব্যবসা কিংবা বিনিয়োগ পরিবেশকে কখনো উন্নত করতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন টিকে গ্রুপের এ পরিচালক।

জিপিএইচ গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ন্যূনতম কর ব্যবস্থায় ব্যবসায়ীদের কার্যকর মূলধন ক্ষয় হচ্ছে। এতে স্থানীয় শিল্প যেমন চাপে পড়ছে, অন্যদিকে বিদেশী বিনিয়োগও নিরুৎসাহিত হচ্ছে।’ তাই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে আয়কর নীতিতে সময়োপযোগী পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

ন্যূনতম কর ব্যবস্থা দেশের শিল্প ও বিনিয়োগবান্ধব কিনা তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যবসা না চললেও শুধু ঘুরতে থাকা টার্নওভারের ওপর কর দিতে বাধ্য হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান কার্যকর মূলধনের সংকটে পড়ছে। অগ্রিম কর্তিত করের তুলনায় কম মুনাফা হলে প্রকৃত করহার বেড়ে যায়। আর লোকসান হলেও ওই কর সমন্বয়ের সুযোগ নেই। ফলে কমে যায় কোম্পানির মূলধন।’

আমিরুল হক আরো বলেন, ‘এনবিআরকে ব্যবসায় সক্ষমতা তৈরিতে উপযুক্ত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। এছাড়া আমদানীকৃত কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্যসহ যাবতীয় শিল্প উপকরণের ওপর আরোপিত অগ্রিম আয়কর এবং ভ্যাট আইনের আওতায় আরোপিত আগাম কর প্রত্যাহারেও উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।’

ব্যবসায় লোকসান হলেও ন্যূনতম কর দেয়ার এমন পদ্ধতি বৈশ্বিক করনীতির পরিপন্থী। তার পরও এনবিআর কর্মকর্তারা এক্ষেত্রে দেখান ভিন্ন যুক্তি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একজন সদস্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে কোম্পানিগুলোর মধ্যে কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে ঘাটতি রয়েছে, নাহলে এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হতো না। স্থানীয় বহু কোম্পানি মুনাফা হলেও লোকসান দেখানোর মতো অপকৌশল অবলম্বন করে।’

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) টার্নওভার কর বৃদ্ধির জন্য সরকারকে চাপ দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগের সম্ভাবনাকে নিরুৎসাহিত করে এমন পদক্ষেপের চিন্তা এনবিআর করে না। তাই আসন্ন বাজেটে এটা প্রত্যাহার কিংবা ট্যাক্স রিফান্ড করার ব্যবস্থা বিবেচনায় রয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *