নিজস্ব প্রতিবেদক : পুঁজিবাজারের ওভার-দ্য-কাউন্টার (ওটিসি মার্কেট) মার্কেটে তালিকাভুক্ত দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা কোম্পানি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ (বিডি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী লিস্টিং আইন লঙ্ঘন করেছেন। এজন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে নির্দেশনা চেয়েছে চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)।
সম্প্রতি এ বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে বিএসইসির কাছে চিঠি দিয়েছে সিএসই। এর আগে ইউনাইটেড এয়ারওজের এমডির কাছে আইন লঙ্ঘনের ব্যাখ্যা চেয়ে সিএসই একটি চিঠি দেয়। কিন্তু তার পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। কিন্তু, কোম্পানিটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পক্ষ থেকে ওই চিঠির কোনো জবাব এখনও পায়নি সিএসই।
সিএসইর পক্ষ থেকে বিএসইসিকে দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৩ আগস্ট ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী স্টক এক্সচেঞ্জের লিস্টিং রেগুরেশন, ২০১৫ এর রেগুলেশন ৭(১) লঙ্ঘন করেছেন। তবে, এ বিষয়ে সিএসই এখনও পর্যন্ত কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছ থেকে কোনো উত্তর পায়নি। সেই সঙ্গে ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে সিএসই এখনো কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তাই, এ বিষয়ে বিএসইসির নির্দেশনা চায় সিএসই।
এর আগে সিএসই থেকে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে লিস্টিং রেগুলেশন ২০১৫-এর রেগুলেশন ৭(১) লঙ্ঘনের জন্য কেন সিএসই আইনি ব্যবস্থা নেবে না, সে বিষয়ে নিজস্ব অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।
স্টক এক্সচেঞ্জের লিস্টিং রেগুলেশন, ২০১৫ এর রেগুলেশন ৭(১) এ উল্লেখ রয়েছে, সিকিউরিটিজ ইস্যুকারীর পক্ষে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বা অনুমোদিত ব্যক্তিকে এই আইন মেনে চলার জন্য একটি সাধারণ সীলমোহর এবং স্বাক্ষরের অধীনে একটি অঙ্গীকারনামা প্রদান করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা না করা হবে, সে পর্যন্ত কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করার অনুমতি দেওয়া হবে না।
এদিকে, কিছুদিন আগে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের আগের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। একই সঙ্গে কোম্পানিটির আর্থিক অসঙ্গতি খতিয়ে দেখতে ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সমাপ্ত হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশেষ নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
কোম্পানিটির পূর্বের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে তাহবিল তছরুপের অভিযোগ আছে। তাই, বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়া, আগের পরিচালনা পর্ষদ ইউনাইটেড এয়ারওয়েজকে কারসাজি করে ইচ্ছাকৃতভাবে লোকসানি কোম্পানিতে পরিণত করেছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে ১০ বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশেষ নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। এ বিষয়ে ৫ সেপ্টেম্বর তদন্তের বিষয়ে বিএসইসি একটি আদেশ জারি করা হয়েছে। তবে, বিশেষ নিরীক্ষার বিষয়ে বিএসইসির কোনো আদেশ জারি করা হয়নি বলে জানা গেছে।
তদন্তের বিষয়ে জারি করা আদেশে উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের সার্বিক বিষয়ের ওপর তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন বলে মনে করে কমিশন। এরই ধারাবাহিকতায় সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ (১৯৬৯ সালের অর্ডিন্যান্স নং xvii) এর ২১ ধারা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন, ১৯৯৩ (১৯৯৩ সালের ১৫নং আইন) এর ১৭ক ধারা অনুযায়ী কোম্পানিটির বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেওয়া হলো।
গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন বিএসইসির অতিরিক্ত পরিচালক মো. ওহিদুল ইসলাম, উপ-পরিচালক শাহরিয়ার পারভেজ, উপ-পরিচালক মো. শাহনেওয়াজ, বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) একজন সদস্য এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মহাব্যবস্থাপক পদমর্যাদার একজন সদস্য। তদন্ত কর্মকর্তাদের এ আদেশ জারির ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে বিএসইসতে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হলো।
দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা ও পরিত্যক্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে ১ লাখ ৬০ হাজার প্রান্তিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকৃত প্রায় ৭৯৩ কোটি টাকার সুরক্ষার্থে বিএসইসি ৮ জন অভিজ্ঞ স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেছে। তবে, কোম্পানিটির সাবেক ফাউন্ডার চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন তাসারুল আহমেদ চৌধুরী বিদেশে পলাতক আছেন। নতুন পরিচালনা পর্ষদ ২০২১ সালের ৪ মার্চ দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই এয়ারলাইনটি পুনর্জীবিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
এদিকে, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বিএসইসি। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে মনোনীত স্বতন্ত্র পরিচালকরা হলেন কাজী ওয়াহিদ উল আলম, এম সাদিকুল ইসলাম, মাসকুদুর রহমান সরকার, এটিএম নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. বদরুজ্জামান ভূইয়া, মুহাম্মদ ইউনুস, মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজ ও সৈয়দ এরশাদ আহমেদ। কোম্পানিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন কাজী ওয়াহিদ উল আলম। ডুবন্ত ইউনাইটেড এয়ারকে সচল করার উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্তে বিনিয়োগ ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন বিনিয়োগকারীরা।
২০১০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ না দেওয়া ও বিভিন্ন সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের কারণে ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মূল মার্কেট থেকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তরিত হয়েছে। একই সঙ্গে গত ছয় বছরের বেশি সময় ধরে কোম্পানিটির সব ধরনের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ আছে।
দীর্ঘ সময় ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করা কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। এ ব্যর্থতার জন্য কোম্পানিটির সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালকসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা দায়ী বলে মনে কমিশন। পরবর্তীতে ২০২১ সালের বছরের ১২ জানুয়ারি ইউনাইটেড এয়ারকে ওটিসি মার্কেটে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি।
এদিকে, ওই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর বিএসইসি ওটিসি মার্কেট বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে, ওটিসি মার্কেটের কোম্পানিগুলোকে আর্থিক সক্ষমতা ও ভবিষ্যত সম্ভাবনার ভিত্তিতে এসএমই প্ল্যাটফর্ম ও এটিবিতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। এরই ধারাবাহিকতায় বিএসইসি’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইউনাইটেড এয়ারকে ওটিসি থেকে এটিবিতে স্থানান্তর করা হবে।
ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ১ কোটি শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে ১০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। তালিকাভুক্তির পরের বছর ২০১১ সালে কোম্পানিটি ১০ টাকা ফেসভ্যালুর সঙ্গে অতিরিক্ত ৫ টাকা প্রিমিয়াম নিয়ে ২১ কোটি রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ৩১৫ কোটি টাকা পুঁজিবাজার থেকে সংগ্রহ করে। ৮২৮ কোটি ১০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির মোট শেয়ার সংখ্যা ৮২ কোটি ৮০ লাখ ৯৮ হাজার ৪৮০টি।
এর মধ্যে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে ২.৫ শতাংশ, প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ১১.০৭ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৮৬.৪৩ শতাংশ শেয়ার আছে। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের শেয়ার সর্বশেষ ২.২০ টাকায় লেনদেন হয়েছে।